আসা যাওয়ার পথের ধারে - জাহান আরা খাতুন
12/06/2009 02:15প্রায়ত আবদুর রউফ চৌধুরী আমার কাছে এক বিস্ময়ের নাম। বিরল এক প্রাণ-পাচুর্যের নাম। অন্তর বেগে তরঙ্গিত গীতিময় এক নদী। তাঁর সাথে পরিচয়ের উষা-লগ্নেই আমি আমোদিত হয়েছি। হিল্লোলিত হয়েছি। সময়ের পরিক্রমায় আমার সে উপলব্ধি আরো প্রগাঢ় হয়েছে। বর্ণময় বোধের আলোকে ক্রমে ক্রমে উজ্জ্বল হয়েছে। দীপ্ত হয়েছে। বার্ধক্যের আপাত জীর্ণতার আড়ালে লুকানো এক টগবগে তরুণের হিরণ্ময় উদ্ভাস, তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত প্রদীপ্তি আমাকে বারবার আপ্লত করেছে। চমকিত করেছে। চঞ্চল করেছে। পরিপ্লুত করেছে।
বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর যৌবনের গান প্রবন্ধে যে তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন, যে তরুণকে বারবার অভিবাদ জানিয়েছেন, ভালোবাসার মুকুট পরিয়েছেন, প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী ছিলেন সেই দীপ্ত তারুণ্যের ধারক ও বাহক। লেখালেখির ব্যাপারে তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ, উত্সাহ, শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবঙ উত্কর্ষ সাধনের নিমিত্তে তাঁর পঠন-পাঠনের ব্যাপকতা আমার মত অনেককেই মুগ্ধ করত। তিনি ছিলেন একান্ত স্বজন। নিকটতম বন্ধু। তাঁর সাথে আমরা ছিলাম আত্মার অচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত।
তিনি একটি পরিচ্ছন্ন অঙ্গনের স্বপ্ন দেখতেন। সমাজ-মনস্ক এ শিল্পী লেখার ব্যাপারে ছিলেন নিরলস, অদম্য সবোর্পরি একাগ্র। তিনি ভাবতেন সমাজের কথা, মানুষের কথা। সমাজের একশ্রেণীর মানুষের ভণ্ডামি, নীচতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কুপ্রথা, শোষণ, নির্যান তাঁর দরদী হৃদয়কে বারবার বিষাদিত করত। বিক্ষুব্ধ করত। অস্থির করত। আগাছা উত্পাটনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিন্যস্ত বগানের স্বপ্নে তিনি বিভোর থাকতেন, আবর্জনার সুউচ্চ পর্বত ভাঙতে চাইতেন কলমের খোঁচায়। তাঁর সাহসী মন-মনন আমাদের অনুপ্রাণিত করত। উজ্জীবিত করত।
তাঁর লেখার মূল সুর মূলত মানববোধ। মানবতার মহত্মন্ত্রে উদ্দীপ্ত এ ব্যক্তিত্ব কুসংস্কারের অচলায়তন গুঁড়িয়ে দিতে তত্পর ছিলেন। বিচেতন সমাজের ঘুম ভাঙাতে উচ্চকিত ছিলেন। তিনি সবুজ শস্যের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। সোনালি ফসলের উত্সব তাঁকে বারবার সৃষ্টি কর্মে উদ্বুদ্ধ করত। কুরীতির বিষবাষ্পে জর্জরিত সমাজের উষ্ঠাগত প্রাণের নীরব আর্তি তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়ের মর্মমূলে আঘাত করত। ধর্মের অতলে যে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের অবস্থিতি তাঁর দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ ছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্ম-কেন্দ্রিক ব্যবসার হীন মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
আসলে তিনি নেই একথা সর্বাংশে সত্য নয়। মানুষ বাচেঁ তাঁর কর্মের আশ্রয়ে। কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। পরম সম্পদের মত ধরে রাখে। এ-অর্থে তিনিও আছেন।
———
Back