মানবতাবাদী লেখক - এম. এ. রব
12/06/2009 02:16বাংলার সচেতন সমাজ বারবার পরাজয়কে ঠেকিয়েছে অথবা পরাজয় থেকে জাতিকে তুলে এনেছে সংগ্রামের মাঝে। ব্রিটিশ ভারত থেকে একতাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আবহমান বাংলার ঐতিহ্য রক্ষার যে ধারাবাহিক সংগ্রাম তা মূলত এদেশের সচেতন সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ধরে রেখেছিল। এখনো এই সংগ্রাম সচেতন সমাজকে কেন্দ্র করেই চলছে। এর চরিত্র অসাম্প্রদায়িক। বাঙালি একটি শংকর জাতি। তার রক্তে একটি অসাম্প্রদায়িক ধারা প্রবাহিত। কিন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা ঘুরে ফিরে সাম্প্রদায়িক ও বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহকদের হাতে পরিচালিত হয়েছে। এতে করে মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ওপর চরম আঘাত আসে। এই অপশাসনে ওরা কিছু মানুষ তৈরি করতে পারেনি বা মোহগ্রস্ত করতে পারেনি এমনটি নয়, বরং একটি বড়ো ভিত এই জাতির ঐতিহ্যের উপর দাঁড় করিয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে এই শক্তির উত্থান দ্রুত ঘটে। ৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবর্তনটা মূলত সেখান থেকেই সূচিত হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যে কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি বাঙালির সামরিক শাসক এবং তার সৃষ্ট রাজনৈতিক দল তা সম্পন্ন করতে পেরেছে। এখানেই বাঙালির পুনরায় পরাজয় ঘটে। কিন্ত লেখক আবদুর রউফ চৌধুরীর পরাজয় ঘটেনি। মূল্যবোধ, ঐতিহ্যবোধ এবং মানবতাবোধে তিনি ছিলেন এসময়ের অগ্রপথিক।
মানুষের পরাজয় ঘটে না। ঐতিহ্যের সাথে যে মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় তা শাশ্বত যা কখনো পরাজয় স্বীকার করে না। মাটি ও মানুষের সাথে মূল্যবোধ সৃষ্টি না হলে সমাজ ভাঙ্গবে সামনে পথ চলার জন্যে। যে সমাজ ভাঙ্গতে পারে না, মরা নদীর মতো একদিন থেমে যাবে। পুরাতন নিয়মনীতি, রীতি, রেওয়াজ বা প্রথা-পদ্ধতি জীবনের জন্যে পরিবর্তন বা পরিমার্জন আবশ্যিক হয়। এমনকি শাস্ত্রিক বিধি নিষেধও যুগোপযোগী করতে হয়। সেখানে ধর্মের দোহাই যতই দেয়া হোক সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে না। জ্ঞানের ধর্মই হলো সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়া। যারা অতীতের জ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে তুষ্ট ও পুষ্ট তারা নতুনকে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে নতুন উদ্ভাবন, নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের বিকাশ তাদের কাছে বেমানান ঠেকে। লেখক আবদুর রউফ চৌধুরী এই পুরাতন মূল্যবোধকে ভেঙ্গে একটি নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। অন্তত তাঁর চিন্তা-চেতনায় এবং লেখায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
লেখক আবদুর রউফ চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসনের বৈষম্যমূলক আচরণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। এই আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে এক সময় তিনি চাকুরী ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। কিন্ত তিনি বাঙালির সংগঠক ছিলেন। প্রাক-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক অবস্থা কোনোটাই লেখককে তৃপ্ত করতে পারেনি। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদে জাগ্রত একজন লেখককে পরবর্তীতে `সবার উপরে মানুষ সত্য`-এ বিশ্বাসে মানুষের মুক্তি চেতয় প্রবিষ্ট হতে দেখি।
———
Back