আব্দুর রউফ চৌধুরী

মুক্তমনা মানুষ - দীপুলকুমার রায়

12/06/2009 02:14

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী সমাজের দশজনের একজন নন। তিনি এগারো জন। বয়সে প্রবীণ হলেো চিন্তাচেতনায় তিনি ছিলেন চির নবীন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৭ বছর কিন্ত জনাব চৌধুরীর মৃত্যু বৃদ্ধদের গতানুগতিক জীবনাবসান নয়। ১৯৯৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি মহান একুশ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা মঞ্চে বক্তৃতারত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ঐদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, মৃত্যুর মাতৃগর্ভ থেকে লাভ করেছেন নবজন্ম। অন্ধকার ও অজ্ঞানতার জঞ্জালস্তূপে দাঁড়িয়ে তিনি সেদিন ঐ মঞ্চে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন সত্র ন্যায় ও মানবতার দুর্জয় বাণী।

উত্তেজিত হলে যে কোনো মুহূর্তে তাঁর হৃদপিণ্ড বন্ধ হবে- ডাক্তরের এ সতর্কবাণী জানা ছিল। তবুও সত্য উচ্চারণে, সত্যের প্রচারে তিনি নিজের জীবনকেও তুচ্ছ মনে করেন। হবিগঞ্জের বিভিন্ন সভা মঞ্চে গর্জে উঠতেন ৬৭ বছরের চিরতরুণ। আবদুর রউফ চৌধুরী, সেদিনের ঐ আলোচনা চক্রে যখন বাঙালি সঙস্কৃতি ও বাঙলা ভাষা নিয়ে বিতর্ক উঠে দ্রোহী আবদুর রউফ চৌধুরী তখনই অকাট্য যুক্তি তুলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। মাতৃভাষা অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে আলোচনার মঞ্চে বীরের মত আবদুর রউফ চৌধুরী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আমি বলবো আবদুর রউফ চৌধুরী আসলে মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেও আমাদেরকে বাঁচাদত চেয়েছেন মৃত্যুদশা থেকে।

হবিগঞ্জের সবচেয়ে সাহসী তরুণের নাম আবদুর রউফ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অকুতোভয় সৈনিকের নাম আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নিজের মাঝে লালন করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক। খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, তাঁর মধ্যে কোনো ভণ্ডামি ছিল না, ছিল না কোনো দোদুল্যমানতা। উচ্চারিত বিশ্বাস ও আদর্শের সাথে তার জীবনাচরণের কখনো বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম আমার চোখে পেড়নি।

প্রবাস জীবনে জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সফলতার জন্য নানাভাবে কাজ করেছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৮৯ সালে দেশে ফিরে এসে কলেজ কোয়ার্টারস্থ নামজুন কুটির নিজ বাসভবনে নীরবে সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার, ধর্মীয় ভণ্ডামি, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখে তিনি বিচলিত হয়ে উঠেন। এসবরে বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার জন্য তিনি লেখনীর মাঝে স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন করেন।

এক সময় নিজের সন্মোহনী শক্তি দিয়ে তিনি কাছে টেনে নেন হবিগঞ্জের সাহিত্য অনুরাগী তরুণদের। তরুণদের নিয়ে তিনি ভাবতেন, ভাবাতেন। নানা অসঙ্গতি ও জিজ্ঞাসা তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। নতুন চেতনায়, নতুন ভাবনায় আমাদের মনকে আলোড়িত করতেন। হবিগঞ্জের তরুণদের উদ্যোগে গঠিত ‘সংযোজন’ নামে সংগঠনটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। নিজে সমুদয় টাকা দিয়ে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে উত্সাহ দিয়েছেন। সংগঠনের শ্লোগান নির্ধারণ করে দিয়েছেন ‘জয় নব উত্থান’। এভাবেই ৬৭ বছরের বৃদ্ধ আবদুর রউফ চৌধুরী সবার অলক্ষোই হয়ে উটে ছিলেন হবিগঞ্জের তরুণ সমাজের নয়নমণি। তরুণদের সঙ্গে নিয়ে আগামী দিনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে তিনি সারাক্ষণ বিভোর থাকতেন।

একথা বলতে দ্বিধা নেই- জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী হবিগঞ্জের সাহত্য অনুরাগী তরুণ সমাজকে সাহসী করে গেছেন। জ্ঞানচক্ষু দান করে গেছেন। বক্তৃতার মঞ্চে নবীন প্রবীণ সকলেই আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদে ও সত্য উচ্চারণে ভীরু ও ক্ষীণকণ্ঠ ছিলাম। আবদুর রউফ চৌধুরীই আমাদেরকে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার সৎ সাহস দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের স্বপক্ষে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর সেই মাথা নত না করার বিদ্রোহী চেতনাই আমাদের আগামী দিনের পথ চলার পাথেয়।

দ্রোহী আবদুর রউফ চৌধুরী যখন বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়াতেন তখন থরথর করে কাঁপতেন। কাঁপতেন তিনি ক্ষোভে, দুঃখে। তাকেঁ তখন মনে হত বাইশ বছর বয়সী বাংলা মায়ের এক প্রতিবাদী যুবক। দেশের জন্য যে কোনো মুহূর্তে তিনি মরতে প্রস্তুত। বুক পেতে দিতে প্রস্তুত। তর্জনী উচিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলতেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ো ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলতেন, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তরুণদের আহ্বান জানাতেন। দ্রোহী আবদুর রউফ চৌধুরী যতক্ষণ বক্তৃতা করতেন আমরা উদ্যোক্তরা ততক্ষণ শংকিত থাকতাম। না জানি কখন কী অঘটন ঘটে যায়। কিন্ত তাকেঁ বারণ করার সাহস আমাদের কারো ছিল না। সাহস করে কেউ অনুরোধ করলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। বলতেন, তোমাদের সাহস না থাকলে আমি মরবো, আক্রান্ত হলে আমি হবো, তবু যা সত্য তা আমাকে বলতেই হবে।

দ্রোহী আবদুর রউফ চৌধুরী স্বভাবে শান্তশিষ্ট, খুবই অমায়িক ও সদালাপী ছিলেন। এই শান্ত মানুষটির ভিতরে ছিল দ্রোহের আগ্নেয়গিরি। যখনই যে স্থানেবাংলা মাকে, বাংলা ভাষাকে, বাঙালির সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করা হয়েছে সেখানেই তিনি তাঁর প্রতিবাদের ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দ্রোহী আবদুর রউফ চৌধুরী বিদ্রোহী কেন? বড় মাপের প্রেমিক ছিলেন বলেই তিনি বিদ্রোহী। বাংলা মাকে, বাংলার মানুষকে, বাংলা ভাষাকে গভীরভাবে ভালবাসতেন বলেই তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বড় প্রেমিকের বড় জ্বালা। তাই তিনি দ্রোহে গরগর করতেন। গভীর ভালবাসাই তাঁকে প্রবল বিদ্রোহী করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শোষণ বঞ্চনামুক্ত বাংলাদেশ ড়ার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতার পচিঁশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরো এ-স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হোয়ায় এক গভীর ব্যাথা তাঁর অন্তরকে সারাক্ষণ পীড়িত করতো। তাই লেখনীর মাধ্যমে আবার তিনি নতুন করে মুক্তিসংগ্রাম শুরু করেছিলেন।  

Back

Search site

© Dr. Mukid Choudhury, 2009 All rights reserved.