আব্দুর রউফ চৌধুরী

golpobhaban

25/12/2009 15:22

 

আবদুর রউফ চৌধুরী‌‌‍'র 'গল্পভুবনে'

শব্দের গাঁথুনীতে সমৃদ্ধ কথামালা

 

সৃজনশীলতাকে ধারণ করেও কোনো কোনো গল্পকার মননশীলতার প্রয়োগ করেন। এরকম একজন গল্পকারের নাম আবদুর রউফ চৌধুরী। প্রচলিত বা জনপ্রিয় ধারার তথাকথিত লেখক হয়তো নন, কিন্তু সাহিত্যের মূল সুর থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তাঁর 'গল্পভুবন' পাঠ করে আমাদের এই ধারণার জন্ম হয়েছে।

আবদুর রউফ চৌধুরীর গল্পের ভুবনে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমে চোখে ধাধিয়েঁ দেয় তার ভাষা। ভাষার বুনট সুন্দর কিন্তু নিশ্চিদ্র, জটিল কিন্তু বোধ্য। তাই ঢোকার পথে একটু দ্বিধা তৈরি হলেও হতে পারে কিন্তু একবার ঢুকে গেলে আর কোনো খানা-খন্দ পথ আটকাতে পারে না।

'গল্পভুবন'-এর প্রথম গল্পটির নাম 'রানী'। গল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে করাচি শহর। মধ্যবিত্ত কীভাবে বদলে যায়, কীভাবে বদলাতে চায়, তারই প্রতীকী বিবরণ আছে গল্পটিতে। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনের কথা বলার ফাঁকেই গল্পকার বলে ফেলেন তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি - 'এক বাঙালি ও এক পাঞ্জাবির মধ্যে মারামারি, কিলঘুষি খুব হয়েছে। দুজনেই এয়ারম্যান, তবুও সিভিলিয়ান পুলিশ তাদের প্রেফতার করে নিয়ে গেছে।' বদলে যাওয়ার সংবাদটিও গল্পকার পাঠকের কাছে গোপন করেন না -

এসব নতুন নতুন গজিয়ে উঠা সর্বগ্রাসী কনক্রিটের বাড়িঘরের জন্য এই শান্ত প্রান্তরটি দিন দিন বদলে যাচ্ছে, এরই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের পরিচয়টুকুও। আবির্ভাব ঘটছে পাঞ্জাবি, পুজরাতি, পুস্তির। বৃদ্ধি পাচ্ছে গাড়ির, জ্যামের, দুষণের; একই সঙ্গে সুন্দরী ও অন্যের স্বামীকে ভাগিয়ে নেওয়ার রঙ-বেরঙ পন্থাগুলোর। [রানী]

'জিন' গল্পটি অসাধারণ। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের শিকার সাধারণ মানুষ কীভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে উজ্জত হারায়, তারই বিশ্বস্ত রূপায়ন ঘটেছে এই গল্পে। এ ধরনের গল্প বাংলাসাহিত্যে আরো আছে। এই অতি পরিচিত বক্তব্যও আবদুর রউফ চৌধুরী ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। জিন তাড়ানোর নামে নারী ধর্ষণের অপকৌশল লেখক উদ্ঘাটন করেছেন সংস্কারমুক্ত হৃদয় দিয়ে। ধর্মকে আঘাত না করেই লেখক ধর্মের ধ্বজাকারী মোল্লাজির বিরুদ্ধে বলেছেন। জিন তাড়ানোর গোটা দৃশ্য এত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া না দিয়ে পারে না। ধর্ষণপূর্ব আয়োজন কিংবা ধর্ষণের দৃশ্যের বর্ণনাও দিতে লেখক কুণ্ঠিত হননি। তবে তৎসমবহুল শব্দের কারণে তেমন অশ্লীল মনে হয়নি। যে ভাষার জন্য আবদুর রউফ চৌধুরীর গল্পকে দুবোর্ধ্য বলে মনে হতে পারে, সেই ভাষাই তাকে রক্ষা করেছে। তবে ভণ্ড মোল্লার চরিত্র অংকনে গল্পকারের মুন্সিয়ানা অস্বীকার করার উপায় নেই। জিনে ধরা আমেনাকে ধর্ষণ করে বিছানায় ফেলে রাখার পর আমেনার স্বামী সিদ্দিক আলীকে সান্ত্বনা দেয় -

আর ভাবনা নাহি। অনেক কষ্ট করিয়া জিনটাকে বিদায় করিয়াছি। [জিন]      

'উপাসী' গল্পের সৌন্দর্য ভাষার আঞ্চলিকতায় ও সংলাপে। সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি প্রভাবশালী টাকাওয়ালা পুরুষের নজর পড়লে কী প্রতিক্রিয়া হয় তারই বিবরণ এই গল্পে। মোহ একসময় ভেঙে গেলে আবার স্বাশীর কাছেই ফিরে আসে। আর গল্পের নায়ক তরমুজের উপলব্ধি সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য-

রাতের ঘন অন্ধকারে তরমুজ তার স্ত্রীর দেহের প্রত্যেকটি ভাঁজ আবার চিনে নিতে চায়। শরীর দিয়েই মানুষ মানুষকে জানে। শরীর হচ্ছে আদি ভালোবাসার উৎস। মানুষের শরীর না থাকলে জীবনে আর কী-ই-বা থাকতে পারে। [উপাসী]

'স্নান' গল্পটির স্বাদও বিচিত্র, প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। লন্ডনের ব্রিকলেনের এক স্নানাগারের কাহিনী এটি। এই ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে এসে নায়ক অমল তার বৌদির প্রতি গোপন আকর্ষণের কথা স্মরণ করে।

'সৃষ্টিতত্ত্ব' গল্পটি অসাধারণ। বাইবেলে-কোরান ঘেঁটে তিনি সৃষ্টিতত্ত্বের সন্ধান করেছেন। পক্ষান্তরে লেখক এখানে বিজ্ঝানের যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছেন। ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লেখকের আক্ষেপ-

হায়-রে ধর্ম! তোমার কাছে শাশ্বত বিজ্ঞানও ম্লান হয়ে যায়। [সৃষ্টিতত্ত্ব]

'অপেক্ষা' গল্পটি করাচিগামী রেলগাড়ির যাত্রী নাসিম আহমেদের স্মৃতিচারণায় ভারতবর্ষের রাজনীতির বয়ান চমৎকার ফুটে উঠেছে। 'পিতা' গল্পে মুক্তিযুদ্ধের এক অন্য ইতিহাস বর্ণিত। 'নেশা', 'আত্মব্রত' ও 'নীলা' গল্পগুলোও আবদুর রউফ চৌধুরীর অভিজ্ঞতা এ প্রজ্ঞার স্মারক।

বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে জন্ম নিলেও পৃথিবীর বহু শহর ঘোরার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ লেখকের জীবন। প্রতিটি গল্পই শিল্পবিচারে উত্তণের দাবিদার। নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে তাঁর নামটি হয়তো বেশি পরিচিত নয়। এই গ্রন্থের গল্পগুলো পাঠ করলে অপরিচয়ের ধাঁধা ঘুচে যাবে। আমরা পাব শব্দের গাঁথুনীতে সমৃদ্ধ কথামালার এক মহান গল্পকারকে আবিষ্কারের আনন্দ।

ড. তপন বাগচী

ঢাকা

Back

Search site

© Dr. Mukid Choudhury, 2009 All rights reserved.