আব্দুর রউফ চৌধুরী

জিন (গল্প) -আব্দুর রউফ চৌধুরী

জিন -আব্দুর রউফ চৌধুরী

 

১.
ধূসর আকাশে কঠিন পাথরের মতো আধখানি চাঁদ নেহাত কর্তব্যের খাতিরে মেঘের ভারি লেপের নিচ থেকে তার অলস মুখটি একটুখানি বের করেই, ক্লান্তি দূর হয়নি বলে, আবার ঢুকে পড়ল পেতনীর ঘনকালো চুলের ভেতর। মেঘ ও অন্ধকার স্রোতের মতো ভেসে চলেছে পৃথিবীর উপর দিয়ে; এই মেঘান্ধকারাচ্ছনড়ব পরিবেশে জোনাকি পোকা তো ছাই, তারাগুলোর আত্মপ্রকাশ করাই কঠিন। মেঘান্ধকার দিব্যি ফুরফুরে হাওয়ার ওপর ভর দিয়ে আসমানজমিন সাঁতরে তালগাছের মাথা খুঁজে চলেছে, আর গোপাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ কলাগাছটি নীরবে আঁকড়ে রয়েছে মাটি ও পানি। চাঁদ উঁকি দিল আবার, সঙ্গে সঙ্গে চাঁদকে নিয়ে বাঁশবনের ফাঁকে কচুরিপানাগুলো লুকোচুরি খেলা শুরু হল; এ-দেখে বুক থেকে অভিমান ঠোঁটে এনে চাঁদকে গেঁথে ফেলল মেঘ। বাতাস ঝুলন্ত পৃথিবীর শিরা-উপশিরা কাঁপিয়ে দপদপ করে জেগে উঠতে-না-উঠতেই চাঁদ রাগের মাথায় মেঘের গায়ে নখ আঁচড়াতে লাগল। যত না অভিমান করছে মেঘ তত বেশি ছুটে চলেছে বাতাস। একসময় শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি, ক্ষণে অক্ষণে বিজলির চমকÑপেতনীর দাঁত খিঁচুনী যেন। বাতাস আর পানির ঘ্রাণ অগ্রিম পেয়ে মাটির শঙ্কাকুল অবস্থা। অনেকক্ষণ ধরে আকাশের গুম হয়ে থাকা গুমোট ভাবটি কাটিয়ে উঠতে-না-উঠতেই হঠাৎ বৃষ্টি নামতে শুরু করল। সেই থেকে গাছগাছালি আবারও জলখেলায় মেতে উঠল। অকালের বাতাস যত চমকে ওঠে বৃষ্টিও তত ঝুমুর ঝুমুর তাল তুলছে, তারপর বৃষ্টি ও বাতাস একসঙ্গে মাটির ঘরের ঝুঁটি ধরে প্রলয়তা-বনৃত্য শুরু করল। পাশের বাড়ির মরচে ধরা টুটোফুটো টিনের ওপর আছড়ে পড়া অসংখ্য বৃষ্টিকণার অসহ্য আওয়াজে ছনের ঘরের মধ্যে বসেও বোবা-কালার মতো কা-কা করা ছাড়া উপায় কী! চিৎকার করে কথা বললেও মনে হয় কানের কাছে কে যেন শুধু ফিসফিস করছে, তবুও সিদ্দিক আলীকে কথা বলতে হচ্ছে, ‘মাতছ না ক্যানে?’ উত্তর পেল না সে। মাটির বিছানা আঁকড়ে-থাকা সিদ্দিক আলীর স্ত্রী স্তব্ধ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, ঘরের কোণে জমে ওঠা অন্ধকারকেও সে ভয় পাচ্ছে, অথবা সে গভীর ঘুমে আচ্ছনড়ব। সিদ্দিক আলী সন্দিগড়ব দৃষ্টিতে তাকাল আবার। তার কোমলসিড়বগ্ধ মনে শঙ্খচিল ঘুরে ঘুরে অবিরাম স্বপড়ব দেখাচ্ছে। তার স্ত্রীর কালো ডাগর চোখের ওপর প্রলেপ মেখে থাকা ঘনপালক ঘেরা আঁখিপল্লব নিশ্চুপ, মাথায় ঘোমটা নেই, ঘুমন্ত চোখে শুধুই অদ্ভুত বাস্তবতা, তবে মুখটি খুবই রোগা-রোগা দেখাচ্ছে। না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে তার স্ত্রী! সিদ্দিক আলীর মন বলছে যে, না, এখনও তার চৈতন্য ফিরে আসেনি। একসময় সে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল তার স্ত্রীর বাঁ-হাতটি; চুড়িতে মৃদুমন্দ ঝঙ্কার উঠল, তারপর নিঃশব্দ। হাতের ছায়া মিলিয়ে গেল মাটির দেওয়ালে, আর দেওয়ালের অপরপাশে বাতাসের ঝাপটায় একটি সুপারিগাছ ভেঙে পড়ল। সিদ্দিক আলী ঘরের মধ্যে জমে ওঠা অন্ধকারের শাখা-প্রশাখা অদৃশ্যে সরিয়ে বর্গা-ধর্ণার সন্ধান করতে লাগল। অন্ধকারের ঘাড় চেপে মেঘ ঝলসে বিদ্যুচ্চমকালো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়া বাদলের ভারে আকাশ ভেঙে পড়ল উঠোনে যেন। তাড়াতাড়ি সিদ্দিক আলী দৃষ্টি ফিরাল তার কোমলকুসুমনয়না স্ত্রীর দিকে, হয়তো অল্প পরেই তার জ্ঞান ফিরবে। পুরো না-হলেও অর্ধেকটা স্বস্তি বোধ করল সে। এইটুকু করতে কী না দাপট গেছে তার স্ত্রীর রক্তমাংসের ওপর দিয়ে, এ-যেন ছিল দেবতা আর দৈত্যের লড়াই, বাতাস আর মেঘের তুফান, দুর্বল আর শক্তির যুদ্ধÑসত্যিই তাই। প্রেতাত্মা ভর করেছিল তার স্ত্রীর দেহে, একেবারে টায়টায় ভর। একাজে অবশ্য আকমল মোল্লার নাম-ডাক আছেÑএকথা জেনেই সিদ্দিক আলী দৌড়ে গিয়েছিল তার কাছে। প্রথমে তিনি আসতে চাননি, রাতের আঁধারে নদী পাড়ি না-দেওয়ার অজুহাতে; পরে চুন-জর্দা মিশানো পান খেতে খেতে লোভী কাকের মতো বৃষ্টি মাড়িয়ে, বাতাস গলিয়ে, বাঁশবনের ব্যাঙের ডাক এড়িয়ে, হাসিখুশি মুখে এসে উপস্থিত হলেন।
রোগিণীর পাশে রাখা প্রদীপটি টিপটিপ করে জ্বললেও আবছা অন্ধকার নিঃশব্দে ঢেউ তুলছে, আধা-আলো আধা-আঁধারে মুখটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। মোল্লাজি মাটির বিছানায় পা গুটিয়ে বসে রোগিণীকে তীক্ষè দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘প্রেতাত্মা, জিন কাবু করিতে সময় লাগিবে।’ সিদ্দিক আলী নিশ্চুপ, শুধু তার দুটো চোখ দরজার ফাঁকে বাইরে ঘুরতে লাগল। একসময় সে দেখতে পেল, কোঁকড়ানো কালোমেঘের ঝাঁক চাঁদকে আগলে রেখেছে, বাতাস দরজার পাল্লার সঙ্গে হোঁচট খাচ্ছে। সেখান থেকে দৃষ্টি ফিরাতেই দেখতে পেল, রোগিণী জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে; তবে বুঝতে পারছে না, কেমন করে যেন একটি অচেনা গন্ধ এগিয়ে আসতে থাকে। মোল্লাজি তার শকুনি দৃষ্টি রোগিণীর দেহে স্থাপন করে বললেন, ‘আইনজা করিয়া ধর সিদ্দিক আলী। জিনকে বশীভূত করিতে হইলে শক্তি লাগাইতে হইবে স্বৈরাচারি শাসকের মতন।’ সিদ্দিক আলীর বুক টনটন করে উঠল, তার চোয়ালের হাড়গুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মোল্লাজি আবার বললেন, ‘নিকটে আসিয়া বহ্, পিছন থাকিয়া নেউলের মতন আঁকড়াইয়া ধরো।’ তার স্ত্রীকে শোয়া অবস্থা থেকে নির্দয়ভাবে সিদ্দিক আলী একটানে বসিয়ে দিল। তারপর তার লৌহকঠিন হাতে তার স্ত্রীর উরসের মাঝেখানের ত্রিবলি খামচে ধরল; সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল অন্যের শরীর ভোগ করার একরকম টসটস ভাব। মোল্লাজি জিনে ভর-করা গৃহবধূর মসৃণ কেশগুচ্ছ আলতোভাবে বুলিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন, তারপর কানের কাছে নাক এনে পরের জিনিশ ভোগ করার গন্ধটি শুঁকে বললেন, ‘তেরি নাম কিয়া হে?’ মোল্লাজির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বকবক গন্ধ রোগিণীর মাথাকে বিগড়ে দিল, বলল, ‘আমেনা।’ মোল্লাজি এবার আবিষ্কার করলেন আমেনার সঙ্গে আলাপ করার গোপন পন্থাটি। কুটিল নজর রোগিণীর জড়–লখানায় স্থাপন করে ধ্বনিহীন বাক্যে, অপ্রকাশ্যে, বললেন, ভালই হইয়াছে, এবার জিনের সন্ধান করিতে অসুবিধা হইবে না। তারপর প্রকাশ্যে বললেন, ‘তেরি নিকট থাকিয়া কয়েকটি তথ্য জানিয়া লইতে চাহি। সত্য, সত্য ফরমাইতে হইবে। বলিয়া দাও, তেরি আসল নাম কিয়া হে?’ উপেক্ষিত নারী আবারও বলল, ‘আমেনা।’ বাকবাকুম আর বাকবাকুম। মোল্লাজি রোগিণীর সঙ্গে কথার চরকা কেটে চললেন। সিদ্দিক আলীর বুকের ওমে আমেনার শরীর গলতে শুরু করলেও মন আপোস মানতে নারাজ; আর মোল্লাজি মনমতো উত্তর না-পেয়ে চিত্তবিকার-বিক্ষেপে ক্ষেপতেই লাগলেন; তিনি প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর যে, জিনের সঙ্গে আলাপ করছেন, আমেনার সঙ্গে নয়। শুধু ভর্ৎসনা বা কটুবাক্যই নয়, তার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে আমেনাকে নির্মমভাবে প্রহার করার জন্য। মোল্লাজি অসহায় সিদ্দিক আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যেমনি করিয়াই হউক আজি রাত্রি জিনকে তাড়াইতে হইবে। শরীরে কিলগুতা বসাইলে জিন এমনি এমনিই কাটিয়া পড়িব।’ সিদ্দিক আলীর মুখে চিন্তার ছাপ, প্রদীপের আলো ও ছায়া ষোলকটি কাটতে লাগল তার চওড়া কাঁধে, হাতের পেটানো পেশিতেও; তবে বিষণড়ব কিন্তু গভীর চোখে তাকিয়ে রইল মোল্লাজির দিকে। বৃষ্টিভেজা রাতে স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়ার মধ্যেও তার পেটানো বুক স্বেদে সপসপ করছে, আমেনার শরীরে আলাদা তাপ তাই হয়তো, তবুও সে একবার আড়চোখে দেখে নিল তার হাতের মধ্যে বন্দী থাকা থরথরে কালোছায়াটিকে। আমেনার দেহলতা দারুণভাবে শক্ত হয়ে উঠেছে, এমনকি প্রকৃতির বিবর্তনে নিপুণতায় গড়া তার উরসিরুহ-দুটোও নড়তে চাচ্ছে না, তার গালও না; সেই গালে মোল্লাজির নির্দেশে সিদ্দিক আলী চড়থাপ্পর বসাল। অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে আমেনার চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল কয়েক বিন্দু জল, যেন বেদ্বীন জিনের কাতর আর্তনাদ। আমেনার পাশে বসা মোল্লাজি হঠাৎ কিছুটা টানাটানা ও কর্কশ স্বরে হেসে উঠলেন। হাসি থামলে আড়চোখে আমেনার বুকের স্ফুটনোন্মুখ দুটো চুচুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলিবা না? তোমাকে বলিতেই হইবে।’ আর অস্পষ্ট ভাষায়, অর্থাৎ মনে মনে, আমেনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, না বলিলে আজি রাত্রি তোমার যোনিরস চুষিয়া খাইব। কিন্তু কথাগুলো কোনও মতেই তার ঠোঁটের ফাঁকে বেরিয়ে এল না, বরং তার কণ্ঠ এর আগেই থেমে গেল। তাকে নেশায় পেয়েছে, মাগির নেশায়; তার ছোটো ঘোলাটে চর্মচক্ষু-দুটো ঘোর স্পন্দনে জেগে উঠল আবার। মোল্লাজির ব্যবহার প্রত্যক্ষ করে সিদ্দিক আলীর হৃৎপি- দ্রুতলয়ে নাচতে লাগল, কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ পেল না, বরং আমেনাকে দেখতে দেখতে একটু-আর্ধেকটুকু উষ্ণতা μমশ সঞ্চয় হতে লাগল তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রূপসীর দেহলতা কেমন যেন বিচিত্র চিরন্তনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তার চোখে, তাই হয়তো সে দাঁত দিয়ে এমুহূর্তে আমেনার কপোলকে কামড়ে ধরতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে কই, বরং তার চমক ভাঙল যখন মোল্লাজি মিনমিন করে বলতে লাগলেন, ‘নাম তোমারে বলিতে হইবে, নইলে তোমার গভীরে অনুপ্রবেশ করিয়া জিনের জাত মারিয়া দিমু সুন্দরী।’ সিদ্দিক আলীর কাছে এ-যেন আকাশ ফাটা কথা, বজ্রপাত। যদিও মোল্লাজির মুখে পরম আনন্দের একরকম তৃপ্তির হাসি প্রকাশ পাচ্ছে, তবুও সিদ্দিক আলী নিথর পাথর যেন, প্রতিবাদের সব ভাষা তার কাছে অজানা।

২.
ডিমডিম প্রদীপশিখা জ্বলছে সিদ্দিক আলী ও আমেনার মাঝখানে। আমেনাকে এই ক্ষীণ প্রদীপের আলোতে কেমন যেন ছায়া ছায়া লাগছে। সিদ্দিক আলী গোপনে প্রদীপটি আরও কাছে এনে আমেনার মুখের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের ফাঁকে লেপটে আছে ঘন ফেনার ছটা; এই ফেনা বেয়ে, পৃথিবীর চোখ বেয়ে পরাজয়ের গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে যেন সিদ্দিক আলীর চোখে। অন্যদিকে, কৌতূহলের এক সুস্পষ্ট রেখা ভেসে উঠেছে যেন আমেনার অবিন্যস্ত কুন্তলদলে। ঘর নিঝুম, আকাশ নিঝুম, বাঁশপাতা নিঝুম, তবে বাঁশবনে ব্যাঙের দল সুর তুলেছে আবার, ঘ্যাঙোর ঘ্যাঙোর; ডুবাজলে মাছের লাফালাফি চলছে সফাৎ সফাৎ; এসব শব্দের মাঝেই, ঘরের ভেতরকার জগৎটি অচেনা হয়ে উঠেছে সিদ্দিক আলীর কাছে। সে মাটিতে বসে তার কাঁধ থেকে লাল-সবুজ গামছাটি সরিয়ে নিয়ে, এর খুট দিয়ে আলতোভাবে আমেনার মলিন মুখ মুছতে লাগল। ঘরের আবছা-আচ্ছনড়ব অন্ধকারও তার আহ্লাদের ঝিমঝিম ভাবটি উপলব্ধি করছে। আমেনার বুক থেকে শাড়ি সরিয়ে এই বৃষ্টিভেজা রাতে জোরে জোরে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া দিতে লাগল, তাকে শান্ত করার চেয়ে, মনে হচ্ছে, নিজের পরাজয়কেই প্রশান্তির প্রলেপে ঢেকে দিতে চাচ্ছে। একসময় তার অন্তর যখন একটু শান্ত হল তখন সে লুঙ্গির খুট থেকে দিয়াশলায়ের একটি বাক্স বের করে কানের পাশে গুঁজে রাখা বিড়িতে আগুন ধরাল। তারপর বিড়ি টানতে টানতে আমেনার পাশে উবু হয়ে বসে চুপিচুপি ডাকল, ‘আমেনা, উটছ্১ না!’ কোনও সাড়াশব্দ নেই, তবুও শান্তনরম চোখে তাকিয়ে রইল। একটু গভীর, একটু করুণ দেখাচ্ছে আমেনাকে। তার বুকে হাত রেখে নিঃশব্দে একগুচ্ছ ধোঁয়া ছাড়ল। হঠাৎ, অজান্তেই, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। নিবে গেল তার বিড়ির আগুন। সিদ্দিক আলী মনে মনে বলল, না, অকনও২ আমেনার হুঁশ অইছে-না৩। তাক, পরিয়া তাক। হুঁশ অইলেই৪ জাগিয়া উটব। নিজেকে সান্ত¡না দিল। সময় এগুতে লাগল। জিনের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যে কী দারুণ ব্যাপার তা আজ সিদ্দিক আলী স্বচোখে দেখেছে। শুধু কী তা-ই, নিজের হাতে গরম করে নিয়েছিল একটি লাল মরিচ, সরষে তেলে ডুবিয়ে। পেশিতে শক্তি সঞ্চয় করে আমেনার নাকের কাছে কোনও রকম তুলে এনেছিল, কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারেনি। যতবার চেষ্টা করছিল ততবারই তার হাত কেঁপে উঠছিল। অগ্রসর হতে পারেনি বলেই হয়তো মোল্লাজি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আহা, মায়া করিলে চলিবে না। ও এখন তোমার স্ত্রী নহে। জিন। বুঝিলাÑআসল জিন।’
তবুও পারেনি সিদ্দিক আলী। সে নির্বিকার। তার মুখ পাংশু হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে যে, শেষ পর্যন্ত কী আমার ভাগ্যে ছিল অন্যের আদেশে আমেনার ওপর অত্যাচার চালানো। মোল্লাজি মরিচটি কেড়ে নিয়ে নির্মল হাসি হেসে বললেন, ‘তুমি বাহিরে যাও। আমাকে বহু কঠিন কঠিন ব্যবস্থা লইতে হইবে। তুমি সহিতে পারিবে না।’ সিদ্দিক আলীর নিপাটনগড়ব বুকে মোল্লাজি যেন শাবল মেরে থেঁতলে দিলেন। মখমলের মতো ব্যথা নিঃশব্দে আঁচড় কাটতে লাগল তার হাড়ের নিচে; চিড়চিড় করে উঠল তার অন্তরাত্মা। সে জানে, জিন-বল বা ভূত-বল কোনওটাই ছাড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়, তবুও চোট সামলাতে হচ্ছে মোল্লাজিকে। কিছু না-বলে যন্ত্রচালিতের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এল সিদ্দিক আলী; সঙ্গে সঙ্গে একঝলক দমকা হাওয়া লাফিয়ে ঢুকল ঘরের ভেতর, চারদিক ভরে গেল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে। দরজা বন্ধ করতে করতে সিদ্দিক আলী একবার অসহায়ভাবে উঁকি দিল মোল্লাজির দিকে। মোল্লাজির চুলগুচ্ছ, আমালদামাল বাইরের বাতাসের মতো, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার ঘাড় ও কাঁধ জুড়ে। মোল্লাজি একহাতে কাঁপা প্রদীপ ধরে, অন্যহাতে প্রদীপশিখাকে বাতাসের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এরই নিচে আমেনার দেহখানা যেন আখনপাতার মতো বিধ্বস্ত। মুখটি গভীর অন্ধকারের অতলে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে তার পিছনও। দরজা বন্ধ করতেই শিকল ওঠার শব্দে সিদ্দিক আলীর পা-দুটো যেন বরফ হয়ে গেল; সঙ্গে সঙ্গে দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে নীরবে বসে পড়ল। তার নীরবতা ভাঙল অজানা এক আতঙ্কে, কেঁদে ওঠার শব্দে। মানুষের এত কানড়বা কোথায় জমা থাকে? অবিরত μন্দনেও যেন তার চোখের অশ্রু ফুরোয় না, কিন্তু কানড়বার শব্দ যেন মোল্লাজির কানের পর্দা ভেদ করতে অক্ষম। বাইরে হাওয়া ও বৃষ্টির যুদ্ধ ঠিকই চলছে। এরইসঙ্গে শুরু হয়ে গেছে মোল্লাজির একের-পর-এক পরীক্ষানিরীক্ষা, জিন তাড়ানোর সুব্যবস্থা, জানা-অজানা পন্থাগুলোর প্রয়োগ। ফুটন্ত সরষে তেলে ডুবানো আরেকটি লাল মরিচ স্বহস্তে তুলে নিয়ে আমেনার নাসারন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিলেন মোল্লাজি, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। হালকা চিৎকার উঠতেই বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুলে মোল্লাজি ঝাঁপটে ধরলেন আমেনার মূর্ধজগুচ্ছ, তারপর হেঁচকা-টানে গায়ের সর্বশক্তি প্রয়োগে তাকে ঝাঁকতে লাগলেন। মাথার ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠল আমেনা, উঃ-আঃ করতে লাগল। এই অস্থিরতাকে কাবু করতে মোল্লাজি হাঁটু স্থাপন করলেন তার নেতিয়ে পড়া উরুসন্ধিতে। আমেনা বাঘিনীর দৃষ্টিতে জরিপ করতে লাগল মোল্লাজিকে, একইসঙ্গে তার আলামতকেও। রমণীর শরীর দখলের লোভে আগমনলগড়ব থেকেই শেয়ালের মতো জিভ বের করে ঝুঁকে আছেন মোল্লাজি। সুরমাটানা চোখ-দুটো পলকহীন, রমণীর দেহকে শুধু চাখছে। মোল্লাজি বারংবার বলা সত্ত্বেও আমেনা রাজি হচ্ছে না নিজেকে জিন বলে স্বীকার করতে, তাই মোল্লাজি নিজের রাস্তা ধরে আমেনার ঘাস-মাটি সব হাতিয়ে নিতে ওঠেপড়ে লেগে গেলেন। আমেনার মনের মধ্যে ঘোড়দৌড় চলছে; সে তার শাড়ি দিয়ে চাঁদের মতো অর্ধকলা নাভিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে কই; কারণ মোল্লাজি পরমযতেড়ব তার দেহকে মাটির শয্যায় গেঁথে নিয়েছেন। আড়াই-হাতের মোল্লাজির মাথায় আড়াই রকমের মতলব গজগজ করছে; তার মতিগতিও কেমন কেমন যেন; একারণেই হয়তো তিনি ধস্তাধস্তিতে ঘেমে উঠেছেন। মোল্লাজির লুঙ্গিতে ঢেউ তোলা নানারকম অদৃশ্য তরঙ্গ আমেনার শরীরে এসে ধাক্কা লাগছে, সে ঠিকই বুঝতে পারছে ঘাসফড়িং হয়ে তিনি তাকে চেটে নিতে ব্যস্ত। আমেনার চোখ-দুটো, মোল্লাজিকে ছুঁয়ে, তার স্বামীর সন্ধানে ব্যস্ত, কিন্তু কোনও পাত্তা পাচ্ছে না; তবে মোল্লাজি তার কাজে অটল, তিনি কোলা-ব্যাঙের মতো গলার স্বর করে বললেন, ‘তুহি আমেনা না। তুহি কালাচাঁন জিন।’ মোল্লাজিই ঠিক। আমেনা এখন আর আমেনা নয়। আমেনার শরীরে ভর করেছে কালাচাঁন জিন, তবুও এই দেহ যে তার। দাওয়ায় বসে থাকা সিদ্দিক আলী তার স্ত্রী যে কষ্ট পাচ্ছে তা আর সহ্য করতে পারছে না। এমন অত্যাচার কী মানুষ সহ্য করতে পারে? অথচ তার কিছুই করার উপায় নেই। নিজের নিরুপায় অবস্থার জন্য আপনা থেকেই তার চোখের পাতা ভিজে উঠল আবার। তার মুখে বেদনার ছায়া, দমবন্ধ হয়ে আসা অবস্থা যেন। তার স্ত্রীর উপর যে অত্যাচার চলছে তা সহ্য করতে না-পেরে সে তাড়াতাড়ি দাওয়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল, খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টি আর বাতাসের যুদ্ধে নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচতে। বৃষ্টিভেজা হাওয়ার বেসামাল ধাক্কায় কেমন যেন হালকা বোধ করল সে। দাওয়ার কাছে ঘন অন্ধকারে আচ্ছনড়ব একটি ছোট্ট মাটির ঘর, খোলা দরজা; এর ভেতর ডানার আশ্রয়ে বাচ্চা নিয়ে ঝিমুচ্ছে একটি মুরগি; আর এর সামনে জলেভেজা, দাঁড়িয়ে থাকা, বুকের পাঁজর বের করা কুকুরটি, মন্থরগতিতে চলা একজোড়া পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে তাকাল। অন্ধকার সিদ্দিক আলীর চোখে ধাঁধা ধরিয়ে দিয়েছে। সে দেখে, কুকুরের চোখে μোধের আগুন, যেন তেলসিক্ত লাল মরিচÑশয়তানের ত্রিশূল; এরইসঙ্গে ভেসে উঠল ছিলিমে রাখা একটুকরো জ্বলন্ত আংরা, তার বিপদ ও মনের অস্থিরতা কাটিয়ে নেওয়ার আহ্বান যেন। সিদ্দিক আলীর মনের কথা বুঝতে পেরে কুকুরটি তার মুখ ফিরিয়ে নিল; তবে উঠোনের অন্যপাশে অভাবী সংসার সারাদিন একা একা টেনে ক্লান্তির ভারে পাটিতে রাঙাবৌ শোয়ে আছে, পাশে তার ছেলে, অবশ্য তার স্বামী সদরে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না সিদ্দিক আলী। ভাবীর ঘরে গিয়ে এক ছিলিম তামাক চেয়ে নেবে কী! আমেনার আর্তচিৎকার ভেসে এল সিদ্দিক আলীর কানে আবার। তার বুকের মধ্যে কাদা মাটিতে মটোরগাড়ির চাকা যেমনি দাগ কাটে তেমনি ব্যথার আঁচড় কাটতে লাগল, শরীরও কাঁপছে। জিন তাড়ানোর সবচেয়ে কঠিন-কঠোর ব্যবস্থার বোধ হয় প্রয়োগ করা হচ্ছে। জিন যত বেয়াড়া ততই মোল্লাজিকে তেড়ে উঠতে হচ্ছে। বেশরম জিনের জাত। যেমনি কুকুর তেমনি মুগুর প্রয়োজনÑনইলে কী চলে! কার্যসিদ্ধি নিয়ে কথা। আকাশ-পাতাল আবারও মাতাল হয়ে উঠেছে, ঝড়-বৃষ্টির তা-ব খেলা চলছে। সিদ্দিক আলী এলোপাতাড়ি পা ফেলে ছিলিমের সন্ধানে এগিয়ে এল। পৃথিবী অশান্তÑচাল উড়ছে, গাছ ভাঙছে। সর্বনাশের এই আতঙ্কে রাঙাবৌ তার ছেলেকে কাঁথায় আঁকড়ে ধরে দরজা খুলে দিল। প্রকৃতি থাবা মেরে ভেঙে দিল গরুহীন গরুঘরের বেড়া, ডুবিয়ে দিল যে-পথ মাড়িয়ে সিদ্দিক আলী একটু আগে এসেছিল সেই পথ। সে বন্দী হল বৃষ্টিজলরাশিতে। অন্য-পথের সন্ধান না-জানা দিশেহারা সিদ্দিক আলী মুখ থুবড়ে বসে রইল রাঙাবৌয়ের ঘরে। একসময় ছিলিমের সন্ধান পেল। অন্যদিকে বুকে বুক, হাতে হাত, ঊরুতে ঊরু স্থাপন করে, তবে মুখে মুখ লাগিয়ে স্বর্গোদ্যান বিচরণ করতে যতই চেষ্টা করছেন মোল্লাজি ততই আমেনা মাথা সরিয়ে নিচ্ছে, শুরু হল আবারও ধস্তাধস্তি, কোস্তাকুস্তি। অতৃপ্ত, বঞ্চিত, অপূর্ণ রতিμিয়ার ক্ষোভে মোল্লাজির প্রকৃতির উপাদান গোপন অঙ্গটি আমেনার ঘরের মধ্যে বসবাসের সন্ধান করতে না-পেরে বাইরে প্রবলভাবে মাথা কুটে মরছে। ঊরুসন্ধির তৃণরোমে আগুনের অজানা দহন অনুভব করে আমেনা থরথর করে কেঁপে উঠল; তার নাভিমূলও। আত্মার মধ্যে সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেওয়ার একটি আকাক্সক্ষা রচিত হতে-না-হতেই আমেনা ঝাঁপ দিল স্বামীর সঙ্গে মিলনের স্মৃতিতে, রোমাঞ্চকর উন্মাদনায়। বুক কম্পিত, উরু উত্তপ্ত, মন দ্রোহাচ্ছনড়ব। আর তার হৃদয়ে রণহুঙ্কার, মাথায় সূর্যের চেয়েও তেজি বিদ্যুচ্চমক, এটমে এটমে আলোড়ন যেন। বাইরে যতই প্রকৃতি তর্জনগর্জন করছে না কেন ভেতরে কিন্তু একসময় সবকিছু থেমে যায়, শেষ পর্যন্ত জিনই হাল ছেড়ে দিল। আমেনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার শরীর দখল করে নিয়েছেন মোল্লাজি। জিনসাধকের শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা কী রমণীর কর্ম! তাই তো জ্বলন্ত কয়লায় পোড়া লাটিমাছের মতো ব্যথায় মোচড়ে উঠতে লাগল আমেনা। সে চিৎকার করল, কিন্তু কণ্ঠ ফুটল না; শুধু তার মন বলতে লাগল, ঘরের বাইরে থাকা কুকুরের চেয়েও অপবিত্র এই মোল্লাজি; তবে তার মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারল না, তাই হয়তো তার বুক ফুলে উঠেছে। ‘এর মধু পান করিয়াই আমি তোমাকে জিনের হাত থাকিয়া রক্ষা করিব।’ কথাটি মোল্লাজির মনে উদয় হতেই তার পেশিতে রক্তপ্রবাহ দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। মোল্লাজির অদম্য শক্তির কবলে আমেনার দেহের প্রতিটি ভাঁজ আস্তেধীরে স্বর্ণলতার মতো নেতিয়ে পড়ল; কিন্তু তার নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগল উষ্ণ নিশ্বাস, আগুনের স্ফুলিঙ্গ যেন। একসময় মোল্লাজির দেহের চাপ শীতল হয়ে এল। শক্তির বেগ কমে গেল। আবেশ ছড়িয়ে পড়ল তার দেহ জুড়ে। স্খলনের আনন্দপ্রবাহের সফলতায় মোল্লাজির ঠোঁটে তৃপ্তির দুষ্টু হাসির তরঙ্গ ভাঙতে লাগল। এরই একটি তরঙ্গ মুখে ধারণ করে মোল্লাজি ফিসফিস করে বললেন, ‘সর্বসময় আমি তোমারে রক্ষা করিব। জিন তোমারে আর ধরিতে পারিবে না। আমার রস ধারণ করিয়া তুমি পরিপূরক হইয়াছ। তৃপ্তির পূর্ণতা লাভ করিয়াছ।’ একইসময় পুকুরের পাড় ডুবুডুবু করে পৃথিবী শান্ত হল, পাড়ার ছাগলপাল কানড়বা থামাল; তবে সিদ্দিক আলীর দাওয়ার চাল উড়ে গিয়েছে, হা-হা করছে, যদিও ছনের কোনও দোষ ছিল না, দিন কয়েক আগেও সে শক্তহাতে মেরামত করেছিল, বেঁধেছিল ঝাউবেত দিয়ে, তার ওপর ছেঁড়া মাছধরার জালটিও ছড়িয়ে দিয়েছিল। এরইমাঝে সিদ্দিক আলীর দাওয়ার কুকুরটি আশ্রয় নিয়েছে অন্যের দাওয়ায়। অবশ্য মুরগিটি তার বাচ্চাসহ বন্দী অবস্থায় এখানেই রয়ে গেছে; আর উড়ে যাওয়া চালের নিচে আমেনা যে খিড়কিপথে এটা-ওটা ফেলত সেদিকে সিদ্দিক আলী, ঘন অন্ধকার আঁকড়ে থাকা, বিস্ময়ভরা, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। বাতাসের দাপটে রানড়বার হাঁড়িতাগার ঘটিবাটি সিঁকের মধ্যে আত্মগোপন করেও যখন রক্ষা পায়নি তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে এখানে সেখানে। সিঁকেতে যতড়ব করে তুলে রাখা মেহমানদের জন্য চীনা মাটির দু-খানা বাসনও দরজার সামনে পড়ে টুকরো টুকরো। এদেরকে পাশ কাটিয়ে মোল্লাজির অন্তরের মতো শূন্যদৃষ্টিতে সিদ্দিক আলী ঘরে ঢুকে দেখল আমেনা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাটির একপাশে, লাশ যেন। আমেনার শাড়ি ছিনড়বভিনড়ব, যেন ঝড়ের পর কলাপাতা। প্রথমেই অনাবৃত দেহাংশ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করল সে, শরমের ছোঁয়া তার নিজের চোখেমুখে যেন লেপটে আছে; কিন্তু সাফল্যের হাসির বান ভাঙতে লাগলেন মোল্লাজি। হাসি যখন একটু থামল তখন তিনি তার ভাঙা দাঁত বের করে বললেন, ‘আর ভাবনা নাহি। অনেক কষ্ট করিয়া জিনটাকে বিদায় করিয়াছি।’ কথাগুলো বলে মোল্লাজি আড়চোখে তাকালেন সিদ্দিক আলীর চিন্তিত মুখের দিকে। ‘কিতার লাগি আমেনারে জিন আছর করচিল?’ সিদ্দিক আলীর কথায় তার মুখে মৌল্লাজি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজতে লাগলেন! কিন্তু সেখানে মান-অভিমান, দুঃখ-রাগ কোনও কিছুরই আভাস পেলেন না তিনি, তাই হয়তো তার মুখ গলিয়ে চোখ গিয়ে ঠেকাল উঠোনের অন্যপাশেÑহেলে পড়া লেবুগাছের ছায়াটির উপর। ঘরের ভেতর থেকে, অন্ধকারের মধ্য-দিয়ে, গাছটির মাথা চোখে পড়ছে না, পড়লে হয়তো দেখতে পেতেন লেবুগাছটি ফুলে ভরপুর ছিল, ঝড় ও বৃষ্টির দাপটে ঝরে পড়েছে। প্রদীপের আলোতে ঋজু কা-টিও দেখা যাচ্ছে না, গুড়িতে ছড়িয়ে থাকা ঝরাপাতাগুলোও না। মোল্লাজি সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সিদ্দিক আলীর উপর স্থাপন করতেই দেখতে পেলেন, সে মুখ যেন আস্তেধীরে কঠোর হতে শুরু করেছে। মোল্লাজি নিজের মনের কথা গোপন রেখে বললেন, ‘জিনের মতে, হানজাবেলা৫, বাঁশবনে তাহার সঙ্গে তোমার স্ত্রীর মহব্বত হইয়া ছিল।’ আহত অভিমানে সিদ্দিক আলী বলল, ‘অখন কিতা অইব।’ মোল্লাজি বললেন, ‘চিন্তার কোনও কারণ নাহি। নাকে খৎ দিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছে যে, সে আর কোনও দিন এই তল্লাটে আসিবে না। তবুও বলিয়া রাখিতেছি, ভবিষ্যতে আমার প্রয়োজন পড়িলে আমারে ডাকিতে দ্বিধা করিও না।’ এসব বলতে বলতে মোল্লাজি বিদায় নিতে উদ্যত হলেন, আর তখন সিদ্দিক আলী তার গায়ের রক্ত পানি-করা বহুদিনের প্রচেষ্টায় জমানো টাকাগুলো তার হাতে তুলে দিল। মোল্লাজি কাঁপা হাতে দোয়া করে, পকেটে টাকাগুলো গুঁজে, মিলিয়ে গেলেন ঝড়বৃষ্টির প্রলয় শেষের অন্ধকারে।

৩.
ঘণ্টা কয়েক আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছবির মতো সিদ্দিক আলীর মনের পর্দায় ভাসতে লাগল। তন্ময়ভাব কেটে গেলে সে আবার তাকাল আমেনার দিকে। মাত্র এক বছর আগে, আমেনার বাপের ঘাটে পঁচা-পাট ছাড়ানোর জন্য বোঝাই করা নৌকা থেকে ভিজে পাটের আঁটিগুলো গুনে গুনে তুলে দিচ্ছিল সিদ্দিক আলী। তখনই সে লক্ষ করছিল যে, ষোড়শী আমেনা পাটশলার আড়ালে বসে কী যেন করছে। সূর্য তার আভা দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জেগে উঠেছিল কিছুক্ষণ আগে। আমেনাকে সেই আলোতে আধখানি চাঁদের মতো মনে হচ্ছিল সিদ্দিক আলীর কাছে। গরিবের ঘরে আনন্দ আসে ঈদের দিনই শুধু, তবুও আমেনাকে ঘরে তুলে আনার পর, গত এক বছর ধরে, সিদ্দিক আলীর সংসারে আনন্দের কোনও অভাব হয়নি। আমেনার চাঁদমুখ মলিন হয়নি একদিনের জন্যও। আজ সেই মুখে বিষাদের রেখা স্পষ্টভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে সিদ্দিক আলী বুঝল আমেনার শরীর গরম। কাঁথা দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে, নিভে যাওয়া বিড়িতে আগুন ধরিয়ে, ঘনঘন টানতে লাগল; কিন্তু তার দৃষ্টি আমেনার উপরই স্থির। হঠাৎ আমেনার চোখের পাতাগুলো কেঁপে উঠল, ঠোঁটও মৃদুমন্দ নড়ছে। একসময় আস্তেধীরে চোখ-দুটো খুলে আমেনা তাকাল। মুখের কাছে মুখ এনে সিদ্দিক আলী প্রশড়ব করল, ‘কিলাকান৬ লাগতাছে? কষ্ট অইতাছে বুজি?’ সন্দিহান চোখে পালটা প্রশড়ব করল আমেনা, ‘ইবলিসের পোয়াটা গেছেগি৭?’ জিন না মোল্লাজি কার কথাÑঠিক ঠাহর করতে পারল না সিদ্দিক আলী, তবুও আমেনাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘এককুইবারে৮ গেছেগি। হারা জীবনের লাগি বিদায় অইছে। যাইবার সময় ঐ কতাই কইয়া গেছইন মোল্লাজি।’ আমেনার ঠোঁটের কোণে গোপন হাসির ঝিলিক উঠল; সেই হাসি দেখে সিদ্দিক আলী আশ্বস্ত হল, জিন ঠিকই আমেনাকে ছেড়ে পালিয়েছে। সে সসেড়বহে আমেনার শরীরে হাত বুলাতে লাগল। দুজনই নিশ্চুপ। হঠাৎ সিদ্দিক আলী নীরবতা ভেঙে বলল, ‘কিলাকান কেয়ামতই অইয়া গেছে। আমি অখনও বুঝতাছি না হানজাবেলা তুমি বাঁশবনে কিতার৯ লাগি১০ গেছিলায়১১?’ কথাটি শোনামাত্রই আমেনা রক্তজবা চোখে তাকাল তার স্বামীর দিকে। তারপর মুখ ভেংচে বলল, ‘গেছি তো ভালাই করছি। তুমি অত ভাবীর কথায় নাচ কিয়র লাগি কওছান হুনি?’

১ উঠস।
২ এখনও।
৩ হয়নি।
৪ হলেই।
৫ সন্ধ্যাবেলা।
৬ কেমন।
৭ চলে গেছে।
৮ একেবারে।
৯ কীসের।
১০ জন্য।
১১ গিয়েছিলে।

 

Search site

© Dr. Mukid Choudhury, 2009 All rights reserved.