আব্দুর রউফ চৌধুরী

একজন অক্লান্ত কলম সৈনিক - পার্থসারথী চৌধুরী

25/08/2009 01:55

 

একজন অক্লান্ত কলম সৈনিক

পার্থসারথী চৌধুরী

 

[শনিবার, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ]

 

হবিগঞ্জের প্রবীন লেখক জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী তাঁর লেখনীর মাধ্যমে শুধু সুধী মহলের নজরই কাড়েননি বরং তাঁর বিদ্রোহী ও সত্যদ্রষ্টা চেতনা নতুন প্রজন্মকেও আলোড়িত করছে। নবীগঞ্জ থানার মুকিমপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ১লা মার্চ তাঁর জন্ম। বৃন্দাবন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করার পূর্বেই তিনি আউশকান্দি উচ্চ বিদ্যাললে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তানীদের বাঙালিদের প্রতি সামরিক বৈষম্য তাঁকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিম-পাকিস্তানে ছিলেন। তখন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে তিনি লন্ডনে যান এবং ব্রিটিশ সরকারের প্লেন গবেষণা কেন্দ্রে স্পেশ্যাল গ্রেডে চাকরী নেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে তিনি জ্যাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীর সহকারীদের অন্যতম ছিলেন। বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য জনাব চৌধুরী ক্লান্তিহীন ভাবে লিখে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকটি বই আলোড়নও জাগিয়েছে। যুগভেরীর পক্ষ থেকে গত ২রা আগস্ট [১৯৯৪] সাক্ষৎকারটি গ্রহণ করা হয় জনাব চৌধুরীর হবিগঞ্জের কলেজ কোয়ার্টারসস্থ বাসভবন থেকে।

(১) লেখালেখি জগতে কী করে আসলেন?

উত্তর: আমি যখন ১৯৩৯ সালে সাধুহাটি মধ্য ইংরেজী স্কুল থেকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গেলাম মহকুমা সদর মৌলভীবাজর, তখন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা কৃপেশ দত্ত মহাশয় আমরা ক’জন ছাত্রকে ব্রিটিশ বিরোধী মন্ত্রে দীক্ষা দান করতেন, তিনি বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে ইংরেজ আমাদের শোষণ করছে। আমাদের দেশের কাচা চামড়া কত সস্তায় নিয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে; আর জুতো রূপে যখন ফিরে আসছে তখন কত চড়া দামে আমাদের কিনতে হচ্ছে। পাট সম্বন্ধেও একই কথা। অর্থাৎ শিল্পের কাচামাল আমরা সরবরাহ করি স্বল্পমূল্যে। কিন্তু ব্রিটিশ শিল্পজাত দ্রব্য সমূহ অতি উচ্চমূল্যে আমরা ভারতবাসীকে খরিদ করতে হচ্ছে। আমাদের বিশ্বখ্যাত বস্ত্র শিল্পকে পঙ্গু করে তাদের মেশিনজাত বস্ত্রের বাজার সৃষ্টির জন্য আমাদের তাঁতীদের বৃদ্ধাঙ্গুলী কেটে দিল; এ-যে ওপনিবেশিক পুৎজিবাদের নিষ্ঠুরতার নিদর্শন।কৃপেশ বাবু বেশকিছু বই ও পত্রপত্রিকা আমাকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এগুলো পড়ে কী বুঝেছ তা সহজ সরল ভাবে, নিজের ভাষায় লিখে আমাকে দেবে। ভালো হলে আমাদের কাগজে ছাপাব।’ মহকুমা সদর সফতরের কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের বিশেষ আগ্রহ ছিল আমার প্রতি, হয়ত আমি মুসলমান বলে। তবে আমারও প্রয়োজন ছিল তাঁদের সাহচর্যের, নিজের দেশকে [ভারতবর্ষকে] জানার জন্যে, স্বদেশকে জানার জন্যে। সেইসময় আমার মনে সমাজ-চেতনা সৃজনে আরেকজন মহান ব্যক্তিত্বের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। তিনি হলেন সাধুহাটি নিবাসী ভূপেন্দ্র ভট্টাচার্য। সাম্যবাদী কার্যকলাপের জন্যে দীর্ঘদিন কারাবাসের পর মায়ের কোলে ফিরে এসে কিশোরদের প্রতি তাঁর বাণী ছিল, ‘‘তোরা মানুষ হ’, এবং জেনে রেখ মানুষ হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে শ্রেণীচ্যুতি, তথাকথিত জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ, ধর্মভেদ, সর্ব ভেদাভেদ সংহরি করো, সব মানবের সংস্থিতি প্রয়োজন; কারণ মানব সৃষ্টির আদি এক ও অভিন্ন। কাজেই সব মানুষ সমান।’ রুশ-বলশোভিক আন্দোলনের ইতিবৃত্ত সংবলিত গ্রন্থাবলী তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, যা পাঠে জানা যায় যে, কীভাবে সাম্যতন্ত্র সবাইকে মানুষের মত বাঁচার অধিকার দেয়। এই দুই মহোদয়ের সক্রিয় উত্সাহ-উদ্দীপনা প্রদানে লেখালেখির জগতে আমার প্রবেশ-পথ প্রশস্ত হয়; কিন্তু আমি তা সঠিক কাজে লাগাতে পারিনি।

(২) প্রথম লেখা কোথায় ছাপা হয়েছিল?

উত্তর: বাবু কৃপেশ দত্ত তাঁর কথা রক্ষা করেছিলেন। আমার প্রথম লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা স্মরণে আজও পুলকিত হই। সময়টা ছিল ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস।

(৩) কেন লিখেন?

উত্তর: অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লিখি; অথবা নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্য; সুন্দরকে প্রকাশের প্রেরণায়।

(৪) এ-পর্যন্ত ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছে?

উত্তর: এ-পর্যন্ত ছয়টি প্রকাশিত হয়েছে।

(৫) বর্তমান রাজনীতি ও মৌলবাদ সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী?

উত্তর: বর্তমানে আমাদের দেশে প্রকৃত অর্থে রাজনীতি নেই। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। তারচেয়ে উন্নত মনা যাঁরা তাঁরা দেখেন দলীয় স্বার্থ। কিন্তু কেউ দেখছেন না দেশ বা জাতির স্বার্থ। রাজনীতির উদ্দেশ্য বলতে আমি যা বুঝি তা হচ্ছে, মূকমুখে ভাষা ফুটিয়ে তোলা, ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণমুক্ত সাম্য সমাজ। গণতন্ত্র তখনই উত্তম যখন সাম্যতন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। সাম্যতন্ত্রহীন গণতন্ত্র দ্বারা সাধারণ মানুষ অতি অল্পই উপকৃত হয়। শুনবেন, শুধু শাসকগোষ্ঠীর বাগাড়স্বর দু’হাজার সালের মধ্যে সকলের জন্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। দেখতে পারেন, শিশুভাতা, বেকারভাতা, প্রবীনভাতা ইত্যাদি ইত্যাদির প্রবর্তন না-করে, শিশুর শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দায়িত্ব গ্রহণ না-করে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা না-করার মত হৃদয়হীন সরকারী কর্মকাণ্ড। মৌলবাদ বলতে যদি জামাতি নেতৃবৃন্দের কমর্কাণ্ড বোঝানো হয় তাহলে তা অবশ্যই নিন্দনীয় ও সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তারা ধর্মকে সোপান রূপে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করতে চায়। যেমনভাবে তাদের নেতা অধার্মিক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন। এ-ধরণের মৌলবাদ জাতির অগ্রগতির অন্তরায়, সমাজ-প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক, তাই তা রাষ্ট্রের ক্ষতিকারক অপশক্তি, তবে এ-অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে জেগেছে বাঙালি। জাগ্রত ছাত্র-জনতার বিপ্লবে, আন্দোলনে মৌলবাদ টিকে থাকতে পারবে না। সত্যের আঘাতে মিথ্যার মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে ব্যাধ, নির্ঘাত।

(৬) এ সমাজ-ব্যবস্থায় আমাদের কী করণীয়?

উত্তর: আমাদের সমাজে অতীতের সামন্তবাদ সৃষ্ট আশরাফ-আতরাফ, বর্তমান পুঁজিবাদ সৃষ্ট বৈষম্য - পাঁচতলা-গাছতলার ব্যবধান - এর অবসান অত্যাবশ্যক। সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা সমান - এ-সত্য মেনে নিয়ে চাহিদা পূরণে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। অবশেষে - উচ্চ-নীচ, নারী-পুরুষ, জাত-ধর্ম-শ্রেণী নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার প্রাপ্য। সমাজে শ্রেণীভেদ ঘুচিয়ে, বংশের মার্কা মুছিয়ে এসব প্রাপ্য আদায়ের বিপ্লবে, সংগ্রামে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

(৭) আমরা জানি আপনি দীর্ঘদিন বিলাতে অবস্থান করেছিলেন। বর্তমানে কী বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন?

উত্তর: ইংল্যান্ড-প্রবাসকালে আমি ছুটাছুটি করেছি অনেক। কিন্তু তেমন কোনও সফলতা আসেনি আমার জীবনে। তাই পরিশ্রম ক্লান্ত দেহে ব্যর্থ-তৃপ্ত অন্তর নিয়ে ফিরে এসেছি স্বদেশে আনন্দঘন পারিবারিক পরিবেশে। শেষ আশা - বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদানের রক্তে পরিশুদ্ধ আমার জন্মভূামর পূতপবিত্র মাটিতে স্থায়ী বসবাস করবে আমার এ-দেহ।

(৮) কবে বাংলা একাডেমীর জীবন-সদস্য পেলেন?

উত্তর: ২৭শে ডিসেম্বর ১৯৯৩ ইং তারিখে আমাকে জানানো হয়, ‘বাংলা একাডেমীর জীবন-সদস্য পদে অন্তর্ভূক্তির জন্যে আপনার আবেদন গৃহীত হয়েছে।’

(৯) আপনার ছেলে মেয়ে ক’জন ও তারা কোথায়?

উত্তর: আমার ছেলে-মেয়ে চারজন। এক ছেলে ও এক মেয়ে দেশে আর এক মেয়ে ও এক ছেলে ইংল্যান্ডে অধ্যয়নরত।

Back

Search site

© Dr. Mukid Choudhury, 2009 All rights reserved.