আব্দুর রউফ চৌধুরী

জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে - সৈয়দ শাহান উদ্দিন

14/05/2009 23:38

 

তিনি একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। কারণ তিনি নিজেই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। তাঁর কাছে আলো ছিল শিক্ষার, সংস্কৃতির, রুচির, চিন্তার, বিবেকের। দীর্ঘ পরাধীনতার জন্যে যে-দেশে জাতি সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারেনি, যে-দেশে চালু আছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার রাহুগ্রস্থ, তেমন একটি দেশে বা সমাজে আলো জ্বালানোর কাজটি অসম্ভব না হলেও দুরূহ। দু:সাধ্য এই কাজটিই তিনি করতে চেয়েছিলেন। এদেশে কিছুই হবে না যারা বলেন সেসব মানুষদের দলভুক্ত হতে তিনি নারাজ ছিলেন। নিরাপদ সুখী জীবনের পরিবর্তে তিনি আলো জ্বালানোর মতো কঠিন ও বিপদ সঙ্কুল জীবন বেছে নিয়েছিলেন, জীবনের গোধূলিলগ্নে এসেও। সবকিছুই তাঁর বিপক্ষে ছিলো, এক অনমনীয়তা ছাড়া। তাঁর সাহিত্য সাধনা তথা জীবন যাপনের সবটাই ছিলো পরাভূত না হওয়ার কাহিনী। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার মতো দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে যে কজন এদেশে জন্মগ্রহণ করেন তাদেঁরই একজন ছিলেন এই জনপদের দ্রোহী লেখক আবদুর রউফ চৌধুরী।

বাংলাদেশ নামক শ্যামল দ্বীপ সদৃশ ভূখণ্ডে অসৎ ও অসভ্য রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের ভীড়ে আবদুর রউফ চৌধুরী ছিলেন আমার দেখা ব্যতিক্রমধর্মী মানুষের একজন। এদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যে কুৎসিৎ অভ্যাস আচরণ ও নিম্ন রুচির প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সে প্রাধান্য থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও মুক্ত নয়। ফলে ‘সংস্কৃতিসেবিদের’ মধ্যে মতলববাজী, চাটুকারিতা, মিথ্যাচার, ভণ্ডামি ও গোঁড়ামির যে দেখা সাধারণভাবে পাওয়া যায় এর ফলে এখানে বিরাজ করে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদের নিম্ন রাজনৈতিক চিন্তা ও রুচি মতলববাজ সংস্কৃতিসেবিদেরকে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ নীচতার গহ্বরে আটক করেছে তার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি আবদুর রউফ চৌধুরী নিজের জীবনে করে গেছেন। দেশের সর্বত্র সাংস্কৃতিক জগতে এক জঘন্য লবিং গ্রুপিং এর খেলা চলে তা থেকে তিনি সবসময় দূরে থাকতেন। আমাদের দেশে জীবদ্দশায় লেখকের সঠিক মূল্যায়ন কমই হতে দেখা যায়। তাঁর জীবিত কালে আমরা ‘সুবিধাবাদী’ সংস্কৃতিসেবিরা তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ নিদেন পক্ষে লেখককে একটি সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যে পৌর-মিলনায়তনে মিলিত হওয়ার দায়িত্ব অনুভব করিনি ঠিকই, কিন্ত তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নাগরিক শোকসভায় পৌর-মিলনায়তনে আমরা অনেকেই মাইক্রোফোনে কথামালার ঝড় তুলেছিলাম। এতসব কিছুর পরেও কাল তাঁর সৃষ্টকর্মের জন্য তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি বেঁচে থাকবেন। এটাই আমার বিশ্বাস।

তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত শিল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেই শিল্পই খাঁটি যা জীবন সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা দেয় না।’ আবদুর রউফ চৌধুরীর সৃষ্টসাহিত্য এরকম শিল্পের আওতায় পড়ে নি:সন্দেহে। সমাজ সচেতন আবদুর রউফ চৌধুরী নাজিম হিকমতের শিল্পের সংজ্ঞায় তাৎপর্যের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যা সঙ্কুল দেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতা থেকে তিনি লিখতেন। তাঁর সাহিত্য চর্চায় তিনি কখনো বিশ্বাস ও বিবেকের আপস করেননি। আবদুর রউফ চৌধুরী একজন গতানুগতিক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বা ছোট গল্পকার ছিলেন না, কারণ তাঁর অন্তর্ভেদী জীবনদৃষ্টি আমাদের সমসাময়িককালের যে বাস্তবতাকে তুলে ধরতো তা এতই রূঢ় যে পাঠকের কাছে খুব প্রীতিকর মনে হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। সমাজ ও মানুষকে তিনি যে-যে মৌলিক অথচ তির্যক দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন তা তিনি নি:শঙ্ক চিত্তে তুলে ধরেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর লেখার বক্তব্য স্পষ্ট, তাঁর লক্ষ্য ছিলো পাঠককে উজ্জীবিত করা ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। পাঠককে ভুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নয়। আবদুর রউফ চৌধুরীর মতো একজন কঠিন কঠোর লেখক এই সমাজে নন্দিত নয়। জীবন সায়াহ্নে তিনি সাহিত্য চর্চায় ব্যাপকভাবে মগ্ন ছিলেন। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরো তীক্ষ্ণ, আরো শাণিত। লোকান্তরিত হওয়ার কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত তাঁর ‘গল্পসম্ভার’ গ্রন্থে সমাজে বিদ্যমান ও অনেক ক্ষেত্রে বিকাশমান ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ফতোয়াবাজদের মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ অঙ্কনে আন্তরিক প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি।

তাঁকে সাধারণত কথাসাহিত্যিক রূপে অভিহিত করলেও তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন এলাকায়। রম্য-রচনা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, কবিতা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় তাঁর প্রজ্ঞাময় ও বলিষ্ঠ বিচরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। সরস ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে দ্যুতিময় সংলাপে সমাজ চেতনার তীব্র প্রতিবাদের দৃষ্টি ভঙ্গিতে তাঁর লেখাগুলি হয়েছে তির্যক, ক্ষুরধার। মৃতুমুখী বৃদ্ধ বয়সেও আবদুর রউফ চৌধুরী তাঁর কলম থেকে দ্রোহের কালি ঝরিয়েছেন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে। মওদুদীবাদী, রাজাকার, আলবদরদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিলো আমৃত্যু। তাঁর লেখা পড়লে মনে হয় তিনি ফুল, পাখি, প্রেম নিয়ে গল্প লিখতে অভ্যস্ত নন। সাহিত্যে আদিম প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলতে তিনি ছিলেন নারাজ। তিনি নিরন্তর লড়াই করেছেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান প্রতিবন্ধকতা মৌলবাদ ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। তিনি ফেটে পড়েছেন প্রতিবাদে। জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন জাতির বিবেকী সত্তা। ভালবেসেছেন মানুষকে। এক্ষেত্রে তাঁর শৈল্পিক সার্থকতা বা ব্যর্থতার হিসাব সময়ের হাতে। কিন্ত আমাদের চোখে তাঁর প্রয়াসই বড়ো। জীবন চিত্রণের লক্ষ্যে আন্তরিকতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আবদুর রউফ চৌধুরীর সমাজ চেতনার পরিচয় শুধু তাঁর গল্প উপন্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি বেশ কিছু মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যেগুলিতে তাঁর ব্যাপক পঠন-পাঠনের পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো বিষয়ে মনে আন্দোলন উপস্থিত হলে তিনি প্রবন্ধ তো লিখতেনই অনেক সময় দৈনিক পত্রিকায় চিঠিও পাঠাতেন। আয়ুর শেষ সীমান্তে এসেও তিনি লিখেছিলেন অপ্রকাশিত স্মৃতি কথা ‘বিদেশের বৃষ্টি’। সেখানেও বিস্মিত হয়েছি বয়স আর ব্যাধি আক্রান্ত শরীর নিয়ে প্রদীপ্ত যুবকের মতো পৃষ্ঠার-পা-পৃষ্ঠা কপি করে চলেছেন। জ্বরা-ব্যাধি তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তাঁর মস্তিষ্ক-হৃদয় সবকিছুই উজ্জ্বল ছিলো, সক্রিয় ছিলো। শারীরিক দৈন্যতা তাঁর দায়িত্ববোধ-কর্মনিষ্ঠা কোনোকিছুই একটু টলাতে পারেনি। সেখানেও তিনি অনেক সাহসী উচ্চারণ করেছেন যা ক্ষুদ্র এই সমাজের স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা শুনতে অভ্যস্ত নয়। গ্রন্থটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। আশা করি ‘আবদুর রউফ চৌধুরী স্মৃতিপর্ষদ’ দ্রুত প্রকাশের উদ্যোগ নেবে।

আবদুর রউফ চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি ছাত্রজীবনে কংগ্রেসী রাজনীতি দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি আর ব্যক্তিগত রাজনীতি করেননি। তবে বাম রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ আমৃত্যু তাঁর মধ্যে অনির্বাণ ছিলো। সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা; সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আশির দশকে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের পরেও তাঁর মধ্যে সমাজতন্ত্র অটুট ছিলো। পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থা তাঁর পছন্দ ছিলো না। মানুষে মানুষে উঁচু নীচু বৈষম্য তাকেঁ পীড়িত করতো।

Back

Search site

© Dr. Mukid Choudhury, 2009 All rights reserved.